নূর বিষয়ক মতভেদ (পর্ব-১)
ইসলামী শরীয়তের মূলনীতি অনুযায়ী কোন বিষয়কে শরীয়তের দিকে নিসবত করে সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য ঐ বিষয়ের মূলভিত্তি কোরআন বা সুন্নাহয় সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত থাকতে হবে। কোন আয়াত বা হাদীসের ব্যাখ্যা থেকে ভিন্ন কোন বিষয়ের উদ্ভাবন করে সে বিষয়ে মতানৈক্য করা জায়েজ নয়। নূর বিষয়ক মতভেদ কোন ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভাবিত বিষয় কিনা সেটি আমরা এই প্রবন্ধের শেষাংশে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি অয়া সাল্লাম নুরের তৈরি নাকি মাটির তৈরি এই বিষয়ে মতপার্থক্য বিদ্যমান, প্রথমে আমরা প্রত্যেকটি মত এবং তার দলিলসমূহ দেখার চেষ্টা করি। (বিষয়টি বুঝার জন্য প্রত্যেকটি পর্ব বিস্তারিতভাবে পড়া জরুরী)।
১ম মতঃ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নুরের তৈরি নন, বরং মাটির তৈরি। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অধিকাংশ আলেমদের অভিমত।
কোরআন থেকে দলিলঃ
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاء رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحًا وَلا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا
বলুন, আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের মাবুদ হল একজন। অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে। (সূরা কাহাফ-১১০)
إِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِن طِينٍ
যখন আপনার পালনকর্তা ফেরেস্তাদের বললেন-আমি মাটির তৈরী মানুষ সৃষ্টি করব। (সূরা সোয়াদ-৭১)
خَلَقَ الإِنسَانَ مِن صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ. وَخَلَقَ الْجَانَّ مِن مَّارِجٍ مِّن نَّارٍ
তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির ন্যায় শুস্ক মৃত্তিকা থেকে এবং জিনকে সৃষ্টি করেছেন অগ্নিশিখা থেকে। (সূরা আর রাহমান-১৪,১৫)
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن تُرَابٍ
তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি দ্বারা। (সূরা মুমিন-৬৭)
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الإِنسَانَ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ
নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি পঁচা কর্দম থেকে তৈরী বিশুস্ক ঠনঠনে মাটি দ্বারা। (সূরা হিজর-২৮)
قُلْ سُبْحَانَ رَبِّي هَلْ كُنتُ إَلاَّ بَشَرًا رَّسُولاً. وَمَا مَنَعَ النَّاسَ أَن يُؤْمِنُواْ إِذْ جَاءهُمُ الْهُدَى إِلاَّ أَن قَالُواْ أَبَعَثَ اللَّهُ بَشَرًا رَّسُولاً. قُل لَّوْ كَانَ فِي الأَرْضِ مَلآئِكَةٌ يَمْشُونَ مُطْمَئِنِّينَ لَنَزَّلْنَا عَلَيْهِم مِّنَ السَّمَاء مَلَكًا رَّسُولاً
পবিত্র মহান আমার পালনকর্তা, আমি একজন মানব রাসূল ছাড়া কে? লোকদের নিকট হেদায়াত আসার পর তাদেরকে এ উক্তি ঈমান আনয়ন থেকে বিরত রাখে যে, “আল্লাহ কি মানুষকে রাসূলস্বরূপ প্রেরণ করেছেন?” বলুন যদি পৃথিবীতে ফেরেস্তারা বিচরণ করত, তবে আমি তাদের নিকট আকাশ থেকে ‘ফেরেস্তা রাসূল’ প্রেরণ করতাম। (সূরা বনী ইসরাঈল-৯৩, ৯৪, ৯৫)
সুন্নাহ থেকে দলিলঃ
كلكم بنو آدم وآدم خلق من تراب
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা সকলেই আদমের সন্তান, আর আদম মাটি থেকে সৃষ্টি (বাযযার প্রভৃতি, ছহীহুল জামেঃ ৪৫৬৮)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেনঃ মানুষ মাটির তৈরী, ফেরেস্তা নূরের এবং জ্বিনজাত আগুনের তৈরী। (মুসলিমঃ ৫৩৪)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল মানুষের মতই আদম সন্তান ছিলেন, আদম আলাইহিস সালাম যেহেতু মাটির তৈরি তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও মাটির তৈরি। উপরের দলিলগুলো ছাড়াও কোরআন এবং সুন্নাহয় আরও অনেক দলিল রয়েছে যা প্রমান করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাটির তৈরি।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম মাটির তৈরি এ ব্যাপারে কাফেরদেরও সন্দেহ ছিলোনা। কাফেররাতো এই ভেবেই হয়রান হয়ে যেতো যে একজন মানুষ কিভাবে নবি হয়! মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের সংশয়ের জবাব কত উত্তমভাবেই না দিয়েছেন! যদি দুনিয়াতে মানুষের বদলে ফেরেস্তারা থাকতো তাহলে আল্লাহ তাআলা ফেরেস্তাই পাঠাতেন রাসূলরূপে। কিন্তু যেহেতু দুনিয়াতে মানুষ বাস করে তাই মানুষকেই পাঠানো হয়েছে রাসূল হিসেবে। এই স্পষ্ট বিষয়টি সবাই বুঝলেও কিছু বিদআতিরা বুঝতে চায়না। তাঁরা বলতে থাকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম মানুষ নন, যা পরোক্ষভাবে সেই সময়ের মক্কার কাফেরদের কথার সাথেই মিলে যায়। সুতরাং যে ধারণা করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম নূর সে মুলত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামকে ফেরেশতা মনে করে এবং মক্কার কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য স্থাপন করে।
নূরের তৈরি হওয়াটা শ্রেষ্ঠ হওয়ার প্রমান বহন করেনা। শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম শ্রেষ্ঠ এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই। সুতরাং শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নূর প্রমান করার কোন প্রয়োজন নেই।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ ذَکَرٍ وَّ اُنۡثٰی وَ جَعَلۡنٰکُمۡ شُعُوۡبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوۡا ؕ اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰهِ اَتۡقٰکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡرٌ
হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত। (সুরা আল-হুজুরাতঃ ১৩)
নূর প্রমানের পক্ষে মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাকের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি হাদীস পেশ করা হয়ে থাকে। উক্ত হাদিসটি মুহাদ্দিসদের সর্বসম্মতিক্রমে জাল। মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকে এমন কোন হাদীসের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়না। হাদিসটি নিঃসন্দেহে জাল এবং বানোয়াট।