যঈফ হাদীস কি আমলযোগ্য? (পর্ব-১)
যে হাদীসের মধ্যে সহীহ হাদীসের শর্তাবলী বিদ্যমান নয় সেটিকে যঈফ হাদীস বলা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, যার মধ্যে সহীহ এবং হাসান হাদীসের শর্তগুলো অনুপস্থিত তাই যঈফ হাদীস। অর্থাৎ হাদীস সহীহ হওয়ার যে ৫টি শর্তাবলী রয়েছে, যেমনঃ (সনদ মুত্তাসিল হওয়া, বর্ণনাকারীগণের পূর্ণ আয়ত্তশক্তি থাকা, ন্যায়পরায়ণতা থাকা, সনদটি শায না হওয়া, সনদে কোনো ইল্লত বা গোপন দোষ ত্রুটি না থাকা) এই শর্তগুলোর এক বা একাধিক শর্ত যদি অনুপস্থিত হয় তবে হাদীসটি যঈফ হিসেবে বিবেচিত হবে।
“যঈফ হাদীস কি গ্রহণযোগ্য?” এ বিষয়ে জগৎ বিখ্যাত মুহাদ্দিসদের মধ্যে কয়েকটি মতামত রয়েছে। চলমান প্রবন্ধটিতে আমরা যঈফ হাদীস নিয়ে মুহাদ্দিসগণের মতামতগুলো আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
১ম মতঃ যঈফ হাদীস সাধারনভাবে অগ্রহণযোগ্য, অর্থাৎ ফাজায়েল বা আহকাম কোন ক্ষেত্রেই এ ধরনের হাদীস গ্রহণীয় নয়। ইমাম বোখারি রহ, ইমাম মুসলিম রহ, ইয়াহইয়া ইবনু মুঈন রহ. এবং ইবনু হজম রহ. সহ অনেক মুহাদ্দিসগণ এ মতটি গ্রহন করেছেন।
যঈফ হাদীস রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অনুমোদিত কিনা সেটাই সন্দেহপূর্ণ, আর সন্দেহপূর্ণ বিষয়ের উপর নির্ভর করা যায়না। তাই যঈফ হাদীস দিয়ে শরীয়তের কোন কিছুই সাব্যস্ত হবেনা।
২য় মতঃ যঈফ হাদীস কোন শর্ত ছাড়া আহকাম এবং ফাজায়েলের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য। এ মতটিকে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রহ. ও ইমাম আবু দাউদ রহ. এর দিকে নিসবত করা হয়।
এ মতের অনুসারীগণ সতর্কতার ভিত্তিতে যঈফ হাদীসের উপর আমল করে। তাদের মতে ইসলামী ফিকহশাস্ত্রে এমন অনেক বিধান রয়েছে যেগুলো দুর্বল হাদীসের উপর প্রতিষ্ঠিত, এ বিষয়গুলো মুসলমানদের মাঝে এত বেশী প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছে যে এগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা অসম্ভব। তাই যঈফ হাদীস আহকাম এবং ফাজায়েলের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য, তবে এর উপর আমল করা আবশ্যক নয়।
যেমন অপবিত্র বা হায়েজ অবস্থায় কোরআন তেলাওয়াত, মাসহাফ স্পর্শ এবং মসজিদে প্রবেশ করা হারাম হওয়ার ব্যাপারে মাজহাবের ইমামগণ একমত পোষণ করেছেন। কিন্তু এ সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসগুলো মুহাদ্দিসগণের নিকট যঈফ।
৩য় মতঃ যঈফ হাদীস শর্ত সাপেক্ষে ফজায়েলের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। যদি হাদীসটি অতিরিক্ত দূর্বল না হয়, শরীয়তের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক না হয় এবং হালাল-হারাম সংক্রান্ত না হয় তাহলে ফাজায়েলের ক্ষেত্রে আমল করা জায়েয রয়েছে। জমহুর আলেমগণ এ মতটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
ইমাম ইবনুস সালাহ রহ. বলেনঃ
يجوﺯ ﻋﻨﺪ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﻭﻏﻴﺮﻫﻢ ﺍﻟﺘﺴﺎﻫﻞ ﻓﻲ ﺍﻷﺳﺎﻧﻴﺪ ، ﻭﺭﻭﺍﻳﺔ ﻣﺎ ﺳﻮﻯ ﺍﻟﻤﻮﺿﻮﻉ ﻣﻦ ﺃﻧﻮﺍﻉ ﺍﻷﺣﺎﺩﻳﺚ ﺍﻟﻀﻌﻴﻔﺔ، ﻣﻦ ﻏﻴﺮ ﺍﻫﺘﻤﺎﻡ ﺑﺒﻴﺎﻥ ﺿﻌﻔﻬﺎ، ﻓﻴﻤﺎ ﺳﻮﻯ ﺻﻔﺎﺕ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻭﺃﺣﻜﺎﻡ ﺍﻟﺸﺮﻳﻌﺔ ﻣﻦ ﺍﻟﺤﻼﻝ ﻭﺍﻟﺤﺮﺍﻡ ﻭﻏﻴﺮﻫﻤﺎ . ﻭﺫﻟﻚ ﻛﺎﻟﻤﻮﺍﻋﻆ، ﻭﺍﻟﻘﺼﺺ، ﻭﻓﻀﺎﺋﻞ ﺍﻷﻋﻤﺎﻝ، ﻭﺳﺎﺋﺮ ﻓﻨﻮﻥ ﺍﻟﺘﺮﻏﻴﺐ ﻭﺍﻟﺘﺮﻫﻴﺐ، ﻭﺳﺎﺋﺮ ﻣﺎ ﻻ ﺗﻌﻠﻖ ﻟﻪ ﺑﺎﻷﺣﻜﺎﻡ ﻭﺍﻟﻌﻘﺎﺋﺪ
মুহাদ্দিসিনে কেরামদের নিকট মাওযু ব্যতীত যঈফ তথা সনদের দুর্বলতা সম্ভলিত হাদীস সমূহ কে বর্ণনা করা জায়েয রয়েছে। এক্ষেত্রে দুর্বলতা কে জনসমক্ষে প্রকাশ করা জরুরী নয়। তবে শর্ত হলো, উক্ত যঈফ হাদীস আল্লাহর সিফাত এবং হালাল-হারাম বা আক্বাঈদ সম্বলিত হতে পারবে না। সুতরাং ওয়াজ,পূর্ববর্তী ঘটনা,এবং ফাযাইলে আ’মাল ও সকল উৎসাহ প্রদাণ মূলক বিষয়ে যঈফ হাদীসকে বর্ণনা করা যাবে এবং তার ভিত্তিতে আ’মল করা যাবে। (মোকাদ্দামায়ে ইবনুস সালাহ)।
১ম মতের প্রামানিকতাঃ
-
- কোন সন্দেহপূর্ণ বিধানের উপর আমল করা জায়েজ নেই। যঈফ হাদিসের উপর আমল করার অর্থ হলো ধারণার উপর নির্ভরশীল হওয়া, যা শরিয়ত সমর্থন করেনা
রাসূল সাঃ বলেছেন “………যে লোক এই সন্দেহজনক বিষয়গুলো নিজের দ্বীন এবং মান-ইজ্জাতের হিফাযাতের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেবে সে নিরাপদ হল। আর যে লোক এর কিছুতে লিপ্ত হল তার হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ারও সংশয় থেকে গেল” [আত-তিরমিজি ১২০৫]
-
- যঈফ হাদীসের উপর আমল করা মানে যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণের সহিহ হাদীস সংরক্ষণের প্রচেষ্টাকে অবহেলা করা। যঈফ হাদীস থেকে উম্মতকে দূরে রাখতেই তারা তাদের জীবনকে সহীহ হাদীস সংরক্ষণের পথে বিলিয়ে দিয়েছিলেন।
-
- একজন মুসলমান তাঁর পুরো জীবনে সহিহ ও হাসান বা গ্রহণযোগ্য হাদিসের উপর আমল করেই শেষ করতে পারেনা, তাহলে কেন যঈফ হাদিসের উপর আমল করবে?
-
- যঈফ হাদীস উম্মাহর ঐক্যের ক্ষেত্রে বড় রকমের বাধা। কারণ যে সনদের মধ্যে সংশয় রয়েছে সে সনদের মাধ্যমে গৃহীত কোন হাদীস দ্বারা যদি কোন বিধান প্রতিষ্ঠিত করা হয় তাহলে অন্য আলেমগণ যঈফ হওয়ার কারণে এ বিধান গ্রহণ করবেনা এবং উম্মাহর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হবে।
রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ও সাল্লাম বলেছেনঃ
كَفَى بالمرءِ كذِبًا أن يحدِّثَ بِكُلِّ ما سمِعَ
কোন লোকের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে [সত্যতা যাচাই না করে] তা-ই বলে বেড়ায়। (সহিহ মুসলিমঃ ৫)।
রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ও সাল্লাম আরও বলেছেনঃ
دَعْ مَا يَرِيْبُكَ إِلَى مَا لاَ يَرِيبُكَ ؛ فإنَّ الصِّدقَ طُمَأنِينَةٌ وَالكَذِبَ رِيبَةٌ
তুমি ঐ জিনিস পরিত্যাগ কর, যে জিনিস তোমাকে সন্দেহে ফেলে এবং তা গ্রহণ কর যাতে তোমার সন্দেহ নেই। কেননা, সত্য প্রশান্তির কারণ এবং মিথ্যা সন্দেহের কারণ। (তিরমিজিঃ ২৫১৮, সহীহ)।
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘শরী‘আতের কোন বিষয়ে ছহীহ ও হাসান হাদীছ ব্যতীত যঈফ বা দুর্বল হাদিসের উপর নির্ভর করা জায়েয নয়’। (মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১/২৫০)
শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, ‘যঈফ হাদিস অতিরিক্ত ধারণার ফায়েদা দেয় মাত্র। তবে এ বিষয়ে সকল আলেমগণ একমত যে, আহকাম ও ফাযায়েল কোন বিষয়েই যঈফ হাদিসের উপর আমল করা বৈধ নয়’। (তামামুল মিন্নাহ ৩৪ পৃঃ)।
ইবনুল আরাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যঈফ হাদিসের উপর আমল করা জায়েজ নয়। (তাদরীবুর রাবী, ১/২৫)।
২য় মতের প্রামানিকতাঃ
আমাদের কাছে দ্বীন পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আলেমগনের অন্যতম মূলনীতি হলো কোন বিষয়ে তাঁরা যঈফ হাদীস ফেলে যুক্তির আশ্রয় নিতেননা, আর এটা থেকেই যঈফ হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা প্রমানিত হয়।
আল্লামা সুয়ূতী (রহঃ) মুহাম্মাদ ইবনে সাদ আল বাওয়ারদী থেকে বর্ণনা করেন-
كان من مذهب النسائي أن يخرج عن كل من لم يجتمع على تركه قال ابن منده وكذلك أبو داود يأخذ مأخذه ويخرج الإِسناد الضعيف إذا لم يجد في الباب غيره لأنه أقوى عنده من رأي الرجال وهذا أيضاً رأي الإِمام أحمد فإنه قال إن ضعيف الحديث أحب إليه من رأي الرجال
ইমাম নাসাঈ (রহ) এর মাযহাব ছিল তিনি প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির হাদীস বর্ণনা করতেন যাকে তরক করার ব্যপারে মুহাদ্দিসীনগণ একমত হননি। ইবনে মানদাহ বলেন, অনুরূপভাবে ইমাম আবূ দাউদ (রহ) ও তার পন্থা অবলম্বন করেছেন। তিনি দুর্বল সনদের হাদীস নিয়ে আসেন যখন তিনি কোন অধ্যায়ে যঈফ সনদ ব্যতীত অন্য কোন হাদীস না পান। কেননা তার নিকট যঈফ সনদ মানুষের কিয়াস থেকে উত্তম। আর এটা ইমাম আহমাদ (রহঃ) এরও মত। তিনি বলেছেন, যঈফ হাদীস আমার নিকট মানুষের কিয়াসের চেয়ে অধিক পছন্দনীয়। (ইমাম সুয়ূতী, তাদবীবুর রাবী, পৃষ্ঠা ৯৭)
আবু হানীফা (রহঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা’য়ালার রাসূল সাল্লালহু আলাইহি ও সাল্লাম থেকে বর্ণিত যঈফ হাদীস আমার নিকট কিয়াসের চাইতে উত্তম। যঈফ হাদীস থাকা অবস্থায় কিয়াস করা জায়েয নেই। (আল ইহকাম ফি উছূলিল আহকাম)।
আল্লামা ইবনুল কাইউম হাম্বলী (রহঃ) বলেন, ইমাম আহমাদ (রহঃ) যখন কোন অধ্যায়ে কোন আছার পান না, কোন সাহাবীর বক্তব্যও পান না বরং এমন যঈফ হাদীস পান যার বিপরীতে উম্মতের ইজমা বর্ণিত হয়নি তখন তার নিকট উক্ত যঈফ হাদীসের উপর আমল করা কিয়াসের চেয়ে উত্তম। (ইলামুল মুওয়াক্কিয়ীন)।